‘দেশের তরুণ আইটি ইঞ্জিনিয়ার প্রবাসে সফটওয়্যার জগতে ঝড় তুলেছেন’ দেশে টেলিভিশনে এমন খবর মাঝে মাঝেই আসে। বাংলাদেশি ডাক্তার সিডনিতে প্রশংসিত- এ জাতীয় খবরও অহরহ দেখা যায়।
দেশে আইটি ইঞ্জিনিয়ার আর ডাক্তার— এই দুই পেশার মানুষদের নিয়ে একধরনের আজব ধারণা। আইটি ইঞ্জিনিয়ার মানেই ‘দিনরাত গেম খেলে ডলার কামায়’।
আর কেউ ভাবে তারা মহাজাগতিক জিনিয়াস, কেউ ভাবে অবসরপ্রাপ্ত হ্যাকার।
আর ডাক্তার মানেই ‘অতিরিক্ত ফি নেয়’! দেশে আইটি ইঞ্জিনিয়ার মানেই অফিসের একপ্রকার চিরস্থায়ী ব্যাটারি। চার্জ দেওয়া হয় না, তবু সারাদিন চালু থাকতে হয়। প্রজেক্ট শেষ করলে বস বলে, ‘এই কাজ তো আরো সুন্দর হতে পারত।
’ আর ডাক্তার যদি রাতে ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সবাই বলে, ‘মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছে!’ এদেশে বিশ্রাম নেওয়াই একধরনের রাষ্ট্রদ্রোহ।
একজন প্রোগ্রামার বলছিলেন, ‘আমার কোড চললে নীরবতা, না চললে নিন্দা।’
একজন ডাক্তার একদিন বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে ডাক্তার মানে রোগী বাঁচালে স্বাভাবিক, না বাঁচালে খুনি।’
দুই পেশার গল্পই এক-একজনের অস্ত্র স্টেথোস্কোপ, আরেকজনের কিবোর্ড, কিন্তু দুইজনেরই সম্মান নির্ভর করে তারা বিমানে চড়েছে কিনা।
দেশে বসের মুখে শোনা যায়, ‘আমরা সবাই এক পরিবার।’ কিন্তু মাসের শেষে যখন বেতন আসে না, তখন বোঝা যায়- পরিবারে তুমি দত্তক সন্তানও নও।
আর যখন সেই পেশাজীবী একদিন প্রবাসে উড়ে যায়, তখন সবাই বলে, ‘দেশের মেধা পাচার হচ্ছে।’ যখন সে দেশে ছিল, তখন কি কেউ তার মেধা খুঁজে দেখেছিল? তখন তো সবাই খুঁজত ‘সুপার কম্পিউটারের গতিতে ১০ দিনের কাজ ১ দিনে কেন হয়নি!’
দেশে বোঝা, প্রবাসে রত্ন-এই সূত্র এখন পেশাজীবীর জীবনের অঘোষিত নীতি। বাস্তবতা হলো, আইটি ইঞ্জিনিয়াররা কোনো দেশের বোঝা নয়।
তারা আধুনিক যুগের ডিজিটাল কৃষক। তারা কোডে চাষ করে, প্রেজেন্টেশনে ফসল ফলায়, বাগকে তাড়ায় যেমন কৃষক পোকা তাড়ায়।
তারা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এক ক্লিকে, সাইবার নিরাপত্তা রক্ষা করে নিজের মানসিক নিরাপত্তা হারিয়ে। প্রতিষ্ঠানের সুনাম, তথ্য আর ডেটা বাঁচাতে তারা নিজের ঘুম, সময়, এমনকি ছুটির দিনও উৎসর্গ করে। তাদের মাঠ অনলাইন, তাদের জমি সোর্সকোড, তাদের আকাশ সাইবার স্পেস, আর তাদের বৃষ্টি আসে গুগল ড্রাইভে।
তারা ঝড় সামলায় সার্ভার রিস্টার্টে, তারা সূর্য দেখে স্ক্রিনে সূর্যরশ্মির প্রতিফলনে, আর তাদের ফসল-রিপোর্ট, ড্যাশবোর্ড, অ্যাপ্লিকেশন- সবই জমা হয় ডিজিটাল গোলায়, যেখানে স্বীকৃতি কম, কিন্তু শ্রম অফুরন্ত।
বাস্তবতা হলো, ডাক্তাররাও কোনো দেশের বোঝা নয়। তারা এই যুগের নীরব যোদ্ধা-মানুষের শরীর নামের ক্ষেতে দিনরাত শ্রম দেয়। তারা রক্তচাপ মাপে যেমন কৃষক মাপে মাটির আর্দ্রতা, আর ওষুধ দেয় যেমন কৃষক দেয় সার। ফসলের নাম এখানে ‘জীবন।’
পার্থক্য একটাই; তাদের জমি হাসপাতালের বেডে, বৃষ্টি আসে স্যালাইনের ফোঁটা হয়ে, আর ঝড় বয়ে যায় আত্মীয়স্বজনের প্রশ্নে, ‘এইটুকু চিকিৎসা দিতেই এত টাকা?’
শেষ কথা?
এই দেশ প্রতিভাকে ভালোবাসে। তবে সেটা যথাযথ মর্যাদা না দিয়ে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের ক্যাডার/সার্ভিস দিয়ে না দিয়ে রাখার মতো করে! যতক্ষণ না সেই প্রতিভা বিদেশে গিয়ে ভাইরাল নিউজ হয়ে ফিরে আসে ততক্ষণ তার কদর হয় না।
লেখক: প্রকৌশলী মো: নাজমুল হুদা মাসুদ
রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী। সাইবার সিকিউরিটি এনালিস্ট (এসবি-সিআইআরটি)
স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ ও জয়েন্ট সেক্রেটারি (একাডেমিক), বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি।







