ছবি-গ্রামীণফোনের লোগো বা পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ নারীর মুখের ফাইল ছবি
গ্রামীণফোন, টেলিনর ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ ‘পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণের শেষ দিন গত রোববার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী গ্রামে ছুটে আসে গ্রামীণফোন, টেলিনর এশিয়া ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল। তাঁরা স্থানীয়দের পরিবেশনা উপভোগ করেন
শ্রাবণী কর্মকারের (২৪) জগৎটা ছিল মূলত ঘর আর সেলাই মেশিন ঘিরে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম প্রেমতলীর এই গৃহিণী সাংসারিক কাজের পাশাপাশি দরজির কাজ করেন। স্মার্টফোন থাকলেও ইন্টারনেট দুনিয়াটা ছিল তাঁর কাছে অজানা। এক প্রশিক্ষণ তাঁর ভাবনার জগৎটাকেই যেন খুলে দিয়েছে।
চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে শ্রাবণী বলেন, ‘আগে জানতাম, সরকার শুধু মেয়েদের স্কুলের জন্য উপবৃত্তি দেয়। এখন জেনেছি, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ কত সুযোগ-সুবিধা আছে। সরকারি অফিসে না ঘুরে ঘরে বসেই অনেক কিছুর জন্য আবেদন করা যায়। এমনকি অনলাইনে নিজের বানানো পোশাকও বিক্রি করতে পারব, এই সাহসটা এখন হয়েছে।’
একই গ্রামের মল্লিকা কর্মকারের (৪০) ইন্টারনেট নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। অথচ তাঁর হাতে ফোটে অসাধারণ নকশিকাঁথার ফুল। প্রশিক্ষণের পর এখন তাঁর চোখে নতুন স্বপ্ন। মল্লিকা বলেন, ‘আপারা বলেছেন, আমার বানানো নকশিকাঁথা অনলাইনে বিক্রি করে ভালো আয় করা সম্ভব। বাড়ির কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের একটা পথ তো হয়। আমি এখন সেই চেষ্টাটাই করতে চাই।’
শ্রাবণী ও মল্লিকার মতো প্রেমতলীর বহু নারীর কাছেই ডিজিটাল পৃথিবীটা ছিল অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা। পরিবারের পুরুষদের আপত্তি, ফেসবুকের পাসওয়ার্ড অন্যের হাতে থাকা কিংবা অনলাইন প্রতারণার ভয়—এই সংকোচ আর জড়তা ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু গ্রামীণফোন, টেলিনর ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ ‘পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি’ প্রকল্পটি তাঁদের সেই ভয়কে জয় করার গল্প শোনাচ্ছে।
এই উদ্যোগের আওতায় একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা যেন তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখানে তাঁরা শুধু অনলাইন নিরাপত্তাই শিখছেন না বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের জীবনকে আরও সহজ ও সমৃদ্ধ করার আত্মবিশ্বাস অর্জন করছেন।
প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া কলেজশিক্ষার্থী জবা রাণী চৌধুরীর কাছে ফেসবুক ছিল কেবলই ছবি বা ভিডিও দেওয়ার জায়গা। তিনি বলেন, ‘ছবি দিলে ভালো মন্তব্যের পাশাপাশি অনেক বাজে কথাও শুনতে হতো। তখন খুব খারাপ লাগত। এখন আমি জানি, কীভাবে এসব ব্যক্তিকে ব্লক বা রিপোর্ট করতে হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়গুলো শেখার পর অনলাইনে নিজেকে অনেক বেশি সুরক্ষিত মনে হচ্ছে।’
এই প্রশিক্ষণে শুধু নারীরাই নন, অংশ নিয়েছেন তরুণেরাও। শ্রী নিত্যানন্দ নামের এক তরুণ জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা, সরকারি সেবার জন্য অনলাইনে আবেদন এবং সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন, যা তাঁর ভবিষ্যৎ পথ চলায় সহায়ক হবে।
কী প্রশিক্ষণ
আয়োজকেরা জানান, ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে নারীদের কাছে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়া এবং অনলাইন দুনিয়ায় তাঁদের নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিত করা। প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের আটটি প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষের কাছে ডিজিটাল সাক্ষরতা ও অনলাইন নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ পৌঁছেছে, যার ৬৮ শতাংশই নারী। প্রশিক্ষণের আগে যেখানে মাত্র ৬৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন, এখন তা বেড়ে ৮১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে অংশগ্রহণকারীদের কেউই ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারি সেবা পেতেন না, এখন ৭৯ শতাংশই জন্মনিবন্ধন, ভর্তির আবেদনসহ বিভিন্ন সেবা অনলাইনে গ্রহণ করছেন।
প্রকল্পটি আগামী তিন বছরের জন্য দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করছে। এই ধাপে সাধারণ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অংশগ্রহণকারীদের জন্য আয়মূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে, যা তাঁদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে।
প্রকল্পটিতে জাতিগত সংখ্যালঘু, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি, চা-বাগানের শ্রমিক, ট্রান্সজেন্ডার ও নারীপ্রধান পরিবারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণে মূলত চারটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ছোট ব্যবসার ধারণা, ইন্টারনেটে আর্থিক সেবার নিরাপদ ব্যবহার, অনলাইনে সরকারি সেবা পাওয়ার পদ্ধতি এবং সার্বিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা।
প্রশিক্ষণের শেষ দিনে গত রোববার এই বদলে যাওয়ার গল্প শুনতে প্রেমতলী গ্রামে ছুটে আসে গ্রামীণফোন, টেলিনর এশিয়া ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল। গ্রামের মেঠোপথে হেঁটে তাঁরা একটি উঠান বৈঠকে যোগ দেন এবং অংশগ্রহণকারী নারীদের অভিজ্ঞতা শোনেন।

গ্রামীণফোন, টেলিনর ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ ‘পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণের শেষ দিন গত রোববার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী গ্রামে ছুটে আসে গ্রামীণফোন, টেলিনর এশিয়া ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল। তাঁরা স্থানীয়দের পরিবেশনা উপভোগ করেন
গ্রামীণফোন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও টেলিনর এশিয়ার প্রধান জন ওমুন্ড রেভহাগ বলেন, ‘প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা মানুষের সামনে অগ্রগতি ও সুযোগের দরজা খুলে দেয়। এখানকার নারীদের গল্পগুলোই প্রমাণ করে যে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি কতটা রূপান্তরমূলক হতে পারে। সবার জন্য ডিজিটাল বিশ্বকে উন্মুক্ত করতে আমরা সংকল্পবদ্ধ।’
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান বলেন, ‘সংযোগের মাধ্যমে মানুষের ক্ষমতায়ন ও ডিজিটাল বিপ্লবের সুফল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। রাজশাহীর এই অভিজ্ঞতা তারই প্রতিফলন।’
এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক তরুণদের নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহারে সমর্থ করে এক বাস্তবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস।







