গাজীপুরের আদালতে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হওয়ার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন খতিব মোহেববুল্লাহ মিয়াজী। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে
গাজীপুরের টঙ্গীর একটি মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহ মিয়াজী (৬০) পঞ্চগড়ে উদ্ধার হওয়ার পরপরই দাবি করেছিলেন যে তাঁকে অপহরণ করা হয়। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়। এ ঘটনায় মামলার পর পুলিশ তদন্তে নেমে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জানতে পারে, অপহরণ নয়, পুরো ঘটনাটা ছিল সাজানো নাটক। পরে আদালতেও বিষয়টি স্বীকার করেন ওই খতিব।
মোহেববুল্লাহ মিয়াজীর বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামে। তিনি গাজীপুরে টঙ্গীর বিটিসিএল টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব। ২৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে পঞ্চগড় সদর ইউনিয়নের সিতাগ্রাম হেলিপ্যাড এলাকায় পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের পাশ থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় তাঁর দুই পা শিকল দিয়ে একটি কলাগাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল। পরে তাঁকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়
মামলায় কী অভিযোগ করেছিলেন খতিব
উদ্ধার হওয়ার পর মোহেববুল্লাহ মিয়াজী দাবি করেন, ২২ অক্টোবর সকালে টঙ্গীর বাসা থেকে হাঁটতে বের হয়ে তিনি নিখোঁজ হন। এ নিয়ে টঙ্গী পূর্ব থানায় তিনি বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এজাহারে উল্লেখ করেন, হাঁটতে বের হওয়ার পর টঙ্গী শিলমুন এক্সেস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভারশন সেন্টারের সামনে টঙ্গী-কালীগঞ্জগামী আঞ্চলিক সড়কে একটি অ্যাম্বুলেন্স তাঁর পথরোধ করে দাঁড়ায়। এ সময় তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ করে অজ্ঞাতনামা চার থেকে পাঁচজন জোর করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠান। পরে কালো কাপড়ে তাঁর চোখ বেঁধে নির্যাতন করতে থাকেন এবং গাড়ি বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে।
এ ছাড়া পঞ্চগড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোহেববুল্লাহ মিয়াজী একই ঘটনা উল্লেখ করে দাবি করেছিলেন যে ১১ মাস ধরে তাঁকে বেনামি চিঠি দিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এসব চিঠিতে তাঁকে অখণ্ড ভারত ও ইসকনের পক্ষে কথা বলতে বলা হচ্ছিল।
সিসিটিভিতে কী দেখা গেল
টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ২২ অক্টোবর সকাল ৬টা ৪৯ মিনিটে খতিব মোহেবুল্লাহ বাসা থেকে বের হচ্ছেন। এ সময় তিনি সাদা পাঞ্জাবি ও মাথায় কালো পাগড়ি পরে ছিলেন। আরেকটি ফুটেজে ৬টা ৫৩ মিনিটে তাঁকে মসজিদের পাশের রাস্তায় হাঁটতে দেখা যায়। এ সময় এক ব্যক্তি তাঁকে সালাম দেন এবং তিনি সালামের জবাব দেন।
শিলমুন এক্সেস লিংক সিএনজি ফিলিং স্টেশনের বিভিন্ন দিকের তিনটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সকাল ৭টা ১৭ মিনিটে তিনি একাই রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছেন। তিন ঘণ্টার বেশি সময় ওই ফুটেজে ওই রাস্তায় কোনো অ্যাম্বুলেন্স দেখা যায়নি। এমনকি সন্দেহভাজন কাউকে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি।
উত্তরবঙ্গে যাওয়ার গাড়িগুলো সাধারণত বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় যাত্রাবিরতি দেয়। ২২ অক্টোবর বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে বগুড়ার শেরপুর পেন্টাগন হোটেলের একটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, তিনি হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন।
আদালতে কী বলেছেন খতিব
ঘটনার তদন্তে নেমে অপহরণ নাটকের বিষয়টি জানতে পেরে মামলার বাদী মোহেববুল্লাহ মিয়াজীকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হওয়ার কথা স্বীকার করে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪-এর বিচারক যুবায়ের রশীদের কাছে জবানবন্দি দেন তিনি। বিচারক তাঁকে পুলিশের মাধ্যমে পরিবারের জিম্মায় দেওয়ার নির্দেশ দেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে যে মোহেববুল্লাহ আদালতে বলেছেন, ২২ অক্টোবর সকালে টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি বাসা থেকে হাঁটতে বের হওয়ার সময় জিন-জাদু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অবচেতন মনে তিনি মাজুখান এলাকার দিকে যেতে থাকেন। মাজুখানে যাওয়ার পর তাঁর মাথায় আরও এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে। এরপর মাজুখান থেকে অটোরিকশায় তিনি পুবাইল থানার মীরের বাজারে গিয়ে নামেন এবং সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাসন থানার ভোগরা বাইপাস এলাকায় যান। গরম লাগায় মাথার পাগড়ি খুলে তিনি অটোরিকশার আসনের পেছনে রেখে আসেন। তখন তাঁর মাথায় টুপি, গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবি (জোব্বা) ছিল। মুখে ইসলামি ফাউন্ডেশন লিখিত সবুজ রঙের মাস্ক ছিল। চোখে চশমা ছিল।
আদালতে খতিব উল্লেখ করেন, ভোগড়া বাইপাস থেকে একটি বাসে তিনি ঢাকার শ্যামলীতে যান এবং সেখান থেকে আরেকটি বাসে গাবতলীতে পৌঁছান। মাঝখানে কারও সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি এবং কেউ তাঁকে কিছু খেতে দেননি। বেলা দুইটার দিকে তিনি গাবতলী থেকে শ্যামলী পরিবহনে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বাসটি বগুড়ার শেরপুর পেন্টাগন হোটেলে মাগরিবের নামাজে যাত্রাবিরতি দিলে তিনি নেমে নামাজ পড়ে দ্রুত বাসে ওঠেন। রাত আনুমানিক ১১ থেকে ১২টার দিকে পঞ্চগড়ে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া সোনালি রঙের একটি ছোট তালাযুক্ত শিকল আমি অবচেতন মনে পায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি বা অচেতন হয়ে যাই। ঘুম থেকে জেগে আমি নিজেকে পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে দেখতে পাই।’
পুলিশ কী বলছে
এ নিয়ে গতকাল গাজীপুর মহানগর পুলিশের সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে অপহরণের প্রমাণ পায়নি এবং খতিব নিজেই নিজের পায়ে শিকল লাগিয়ে শুয়ে ছিলেন বলে জানায়।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, খতিব নিখোঁজ হওয়ার পর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশ জানতে পারে, পঞ্চগড়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি সব সময় মুঠোফোনে কারও না কারও সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি অপহৃত হলে সারাক্ষণ মুঠোফোনে কথা বলতে পারতেন না। তা ছাড়া পুলিশ দুজনকে সাক্ষী হিসেবে পেয়েছে, যাঁরা তাঁকে বাসে যেতে দেখেছেন।
পুলিশ কর্মকর্তা তাহেরুল হক চৌহান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজেই যেহেতু মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী, তাই তাঁকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছে। পাশাপাশি আরও অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে।







