১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ■ ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

/

বৈষম্যের পিঁপড়া খেয়ে নিচ্ছে সাফল্যের গুড়

বৈষম্যের পিঁপড়া খেয়ে নিচ্ছে সাফল্যের গুড়

||

দৈনিক মাটির কণ্ঠ

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Print



আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য থাকলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য সেটাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য পরিমাপের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি গিনি গুণাঙ্ক (গিনি কো–এফিশিয়েন্ট) অনুযায়ী অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। ২০২২-এর খানা জরিপ অনুযায়ী গিনি গুণাঙ্ক বেড়ে হয়েছে দশমিক ৫০ এবং ২০২০ সালে যা ছিল দশমিক ৪৫। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ার বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় যখন পরিসংখ্যানে উঠে আসে যে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী দেশের প্রায় ৪১ শতাংশ আয়ের অধিকারী, ২০১৬ সালে যা ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ। অপর পক্ষে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ খানা মাত্র ১ শতাংশের কিছু বেশি আয়ের মালিক (খানা জরিপ ২০২২, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)।

তবে আয়বৈষম্য বিবেচনায় আমাদের ভাবনাটা পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে বাস্তবতার নিরিখে হওয়া উচিত। মনে রাখা জরুরি, খানা জরিপের নমুনা চয়নে সমাজের অতি ধনীদের উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে একেবারেই নগণ্য। ধনীদের সম্পদের সঠিক হিসাব না থাকা ও অপ্রদর্শিত সম্পদের কারণে জরিপে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঠিক চিত্র উঠে আসে না। তাই বৈষম্যের প্রকৃত চিত্র পরিসংখ্যানের চেয়ে আরও অনেক ব্যাপক।

কর ও রাজস্বব্যবস্থার দুর্বলতা

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে বলা চলে, অবৈধ অর্থনৈতিক লেনদেন, ঋণখেলাপি, কর ফাঁকি, সম্পদ পাচার তথা দুর্নীতির কারণে সমাজের একটি শ্রেণির কাছে বিপুল পরিমাণে অর্থ পুঞ্জীভূত হয়েছে। শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সময়কালে প্রতিবছর অন্তত ১৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য মাধ্যমে আর্থিক খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ। আয়বৈষম্যে এর প্রতিফলন পড়েছে।

দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সুশাসনের অভাব ছাড়াও করব্যবস্থার কাঠামোগত দুব৴লতা, কর ফাঁকি ও কর আদায়ে শ্লথগতির কারণে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত এখনো মাত্র ৯ শতাংশ। এর ফলে প্রগতিশীল করকাঠামোর মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন ও ধনী-দরিদ্রের আর্থিক ব্যবধান কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনো সুফল আমরা দেখছি না। পাশাপাশি আমাদের রাজস্বব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ করের অনুপাত মোট কর আদায়ের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। প্রত্যক্ষ কর যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে সহায়তা করে, তেমনি প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে পরোক্ষ করের (যেমন ভ্যাট) বোঝা ধনী ও দরিদ্র উভয়ের ওপরই সমানভাবে পড়ে। তাই পরোক্ষ করনির্ভর দুর্বল রাজস্ব আহরণব্যবস্থা বৈষম্য কমাতে সহায়ক হচ্ছে না। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের সীমাবদ্ধতা সামাজিক নিরাপত্তা খাতসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের কম ব্যয় করে—বৈষম্য নিরসন কিংবা দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য যা নিতান্তই অপ্রতুল। এ ছাড়া রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অস্বচ্ছতা ও অনিয়ম। মনে রাখা জরুরি, দারিদ্র্য আর অর্থনৈতিক বৈষম্য ভিন্ন ভিন্ন বিষয় হলেও দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আয়বৈষম্য কমাতেও সাহায্য করতে পারে। সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি চারজনের একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। পাশাপাশি একটি বড় জনগোষ্ঠীর নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে এই চিত্র মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়।

কর্মসংস্থান তৈরিতে শ্লথগতি

দারিদ্র্য দূরীকরণ ও এর মাধ্যমে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে শ্লথগতি। বিগত এক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম। অর্থনীতির ভাষায় এমপ্লয়মেন্ট ইলাস্টিসিটি অব গ্রোথ বা জিডিপির কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতার মান ২০১৬-২০২২ সময়কালে মাত্র দশমিক ৩৪। এটা প্রমাণ করে, প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে সেভাবে পৌঁছাচ্ছে না। এ কারণে বাড়ছে বৈষম্য।

অর্থনৈতিক বৈষম্যের অন্যান্য কারণের বাইরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ভূমিকাও রয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ৮ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের তুলনায় কম (প্রায় ১০ শতাংশ, বিবিএস ২০২৫) হলেও মজুরি বৃদ্ধির হারের তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি। এ কারণে প্রকৃত আয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দীর্ঘদিন ধরে চলা মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলার জন্য সামাজিক কর্মসূচি, বিশেষ করে টিসিবির খোলাবাজার কর্মসূচির অপ্রতুলতা ও অন্যান্য কর্মসূচির সীমাবদ্ধতার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না; বাড়ছে ধনী-দরিদ্রের আয়ের ফারাক।

খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়িয়ে নিম্ন আয়ের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া সম্ভব

মানব উন্নয়নে স্বল্প বিনিয়োগ

মানবসম্পদভিত্তিক অবকাঠামোয় স্বল্প বিনিয়োগ (২০২৫-২৬ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে প্রায় ১২ শতাংশ ও স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৫ শতাংশ বরাদ্দকৃত বাজেট), স্বাস্থ্যবিমার সীমিত ব্যবহার, নিজ খরচে উচ্চ স্বাস্থ্য ব্যয়, শিক্ষাক্ষেত্রে সমতাভিত্তিক সুযোগের অভাব ইত্যাদি যেমন দরিদ্র পরিবারগুলোকে চাপে ফেলছে, তেমনি শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সাপেক্ষে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ও সামাজিক গতিশীলতাও আশানুরূপ হচ্ছে না।

তবে কারণ যা–ই হোক না কেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সার্বিকভাবে একটি সমতাভিত্তিক আর্থসামাজিক কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। বৈষম্য কমিয়ে আনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হতে পারে সঠিক করকাঠামো। করব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধি, যেমন সমতাভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থার দিকে যেতে সহায়তা করবে, তেমনি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক হবে। প্রত্যক্ষ করের ধাপগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার, করজালের আওতা বৃদ্ধি, সম্পদ করের ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপের মতো বিষয়গুলো বৈষম্য কমিয়ে আনার মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করতে পারে।

তবে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য নিরসন সম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শ্রমঘন বৃহৎ শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সম্প্রসারণের জন্য সহায়ক নীতি প্রণয়নের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অতি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পগুলোর জন্য সহজ শর্তে নিম্ন সুদে ঋণ, বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ, বাজারজাতকরণের সহায়তা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিপর্যায়ের শিল্পকারখানা ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে শুধু কর্মসংস্থান নয়, শোভন কাজেরও ব্যবস্থা করা জরুরি।

খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি ও রেশন–ব্যবস্থার পরিধি বাড়ানোর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া সম্ভব। শহরাঞ্চলের বস্তিবাসী, যাঁদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল, তাঁদের জন্য বিশেষভাবে ভাবতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ও জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি এসব অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী (২০২২ খানা জরিপ) বরিশাল (প্রায় ২৬ শতাংশ, উচ্চ দারিদ্র্যসীমা অনুযায়ী) ও রংপুর বিভাগে (প্রায় ২৪ শতাংশ) দরিদ্রের হার সবচেয়ে বেশি। অঞ্চলভিত্তিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা (যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, যোগাযোগব্যবস্থা) নিশ্চিত করা গেলে দরিদ্রের হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বণ্টনের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

কন্যাশিশুদের জন্য শিক্ষা

অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি নিরাপদ ভৌত অবকাঠামো, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের প্রাপ্ততা, জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মপরিবেশ, মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ শিশু দিবাযত্নের ব্যবস্থা, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদির প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু মৌলিক বিষয়ও আমাদের মনে রাখতে হবে। বিভিন্ন অধিকার ও সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা না আনা গেলে আর্থিক অবস্থা ও বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনা কঠিন। শিক্ষার ক্ষেত্রে সম–অধিকার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার মাধ্যমে সমাজের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের উপার্জনের যৌক্তিক সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব। পাশাপাশি প্রয়োজন চাকরির ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকে মূল বিবেচনায় রেখে তরুণদের জন্য বৈষম্যহীন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।

তবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূলোৎপাটন করা তখনই সম্ভব যখন আর্থিক লেনদেন, নিয়োগপ্রক্রিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন ও কিছু ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন এই স্বচ্ছতা আনয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে (যেমন সরকারি ব্যয়) নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নব্যবস্থা থাকা জরুরি, যাতে জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশন আর্থিক সুশাসন আনতে সহায়ক হতে পারে। বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ

গড়তে প্রয়োজন প্রগতিশীল ও কার্যকর করকাঠামো, সমতাভিত্তিক ব্যয় ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সর্বোপরি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিনির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থা।

সায়মা হক বিদিশা: অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি ‍শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

আরো খবর