১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ■ ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

/

মা ইলিশ রক্ষায় ড্রোন নজরদারি, তবু দুশ্চিন্তায় জেলেরা।

মা ইলিশ রক্ষায় ড্রোন নজরদারি, তবু দুশ্চিন্তায় জেলেরা।

||

দৈনিক মাটির কণ্ঠ

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Print

বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার মাঝের প্রায় ৯০ কিলোমিটার মেঘনা নদী। যেটি ‘ইলিশের খনি’ হিসেবে জেলেদের কাছে পরিচিত। সেই খনিতে আজ শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হচ্ছে ২২ দিনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। মা ইলিশ রক্ষায় প্রশাসন এবার হাতিয়ার করেছে ড্রোন।

কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ, র‍্যাব ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে ২২ দিন সার্বক্ষণিক তল্লাশি অব্যহত থাকবে। তবুও প্রশাসন কিংবা জেলেদের আতঙ্ক কমছে না।

 

প্রযুক্তির চোখে নদী

হিজলা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম জানান, অন্তত চারটি ড্রোন দিয়ে নদী নজরে রাখা হবে। যেখানেই জাল পড়বে, সেখানেই স্পিডবোট পৌঁছে যাবে।

তবে মুদ্রার ওপিঠও আছে। অতীত ইতিহাসের কারণে আতঙ্কে থাকতে হয় সরকারি কর্মকর্তাদের। মা ইলিশ রক্ষা করতে গিয়ে একাধিক বার হামলার শিকার হওয়ার অতীত আছে তাদের। একই সঙ্গে আত্মরক্ষায় জেলের জীবনও গেছে।

মা ইলিশ রক্ষায় নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হলেও এসব ঘটনার কারণে আতঙ্ক রয়েই গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশাল মেঘনার প্রতিটি বাঁক ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা কি প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব?

 

মেহেন্দীগঞ্জের মৎস্য কর্মকর্তা ওমর সানি বলেন, সচেতনতা সভা, স্পিডবোট, ম্যাজিস্ট্রেট সবই প্রস্তুত রয়েছে। তবুও অভিজ্ঞতার ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে আশঙ্কা। স্থানীয় মহাজনদের চাপ ও দাদন প্রথার কারণে জেলেরা নিষেধাজ্ঞার মাঝেও নদীতে নামেন। তখনই প্রশাসন-জেলেরা মেঘনায় মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ান।

জেলেদের সংসারে অচলাবস্থাসরকারি হিসাবে বরিশালে ৭৯ হাজার জেলে রয়েছে। এর মধ্যে ৬৬ হাজার ৫২৪ পরিবার পাচ্ছে ২৫ কেজি চাল। তবে জেলেরা অভিযোগ করেন, এটি দিয়ে সংসার চলে না। কিছু পরিবার চাল সময়মতো পায় না। নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন মহাজন থেকে সহযোগিতা না পেয়ে জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করতে বাধ্য হন।

মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়ার জেলে আলী হোসেন বলেন, ‘আমার ছয় সদস্যের সংসারে তিন বেলা খেতে দৈনিক আড়াই কেজি চাল প্রয়োজন। সরকার বরাদ্ধ দেয় ২৫ কেজি। আমরা হাতে পাই ২০ কেজি। এই চাল দিয়ে সংসার চলে না। মাছ ধরতে মানা, সংসার চালাতেও দায়।’

হিজলার টুমচরের জেলে খালেক বেপারী বলেন, ‘এবার মাছ পাইনি, তাই দাদনও শোধ করতে পারিনি। শোধ না করলে বৈশাখে নতুন দাদান পাবো না। তাই টিকে থাকতে জেলেরা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও মেঘনায় নামছে।’

জাতীয় মৎস্য শ্রমিক অধিকার ফোরামের যুগ্ম-আহ্বায়ক এস এম জাকির হোসেন বলেন, ‘ঋণের বোঝা আর ধরা পড়ার ভয়। এই দুই ফাঁদে জেলেরা আটকা পড়ে বাধ্য হয় মা ইলিশ শিকারে।’

নিষেধাজ্ঞার ভেতরেও প্রশ্ন

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ জানান, বরিশালের ৫৯টি ইলিশসমৃদ্ধ ইউনিয়নের টাস্কফোর্সের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। মা ইলিশ নিধনকারীদের বিচারে ৩০ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জেলায় ৭৯ হাজার জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে ৬৬ হাজার ৫২৪ জেলে পরিবারকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।

মৎস্য গবেষকদের মতে, গত বছর প্রায় ৪০ হাজার টন ইলিশ কমেছে। এ বছরও উৎপাদন কমার সম্ভাবনা। ইলিশ সম্পদ রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, ‘এত চেষ্টা করেও জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় সফলতা আসছে না।’

বরিশাল নৌ পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার ইমরান হোসেন মোল্লা জানান, ড্রোন দিয়ে নজর রাখা হবে। আইন ভাঙলে ছাড় নেই। তবে জেলেরা প্রশ্ন করছেন, আইন মানলে সংসার চলবে কি?

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও ইলিশ গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ড্রোনে ধরা পড়বে নদীর প্রতিটি নৌকা, কিন্তু ধরা পড়বে কি জেলেদের বুকের হাহাকার? স্পিডবোটে জাল ধরা যাবে, কিন্তু শিশুর মুখে ভাত পৌঁছাবে কারা?

এ প্রশ্নের সমাধান না হলে অভিযান কিংবা ড্রোনের মতো আধুনিক প্রযুক্তির কার্যকারিতা সীমিত। মা ইলিশ রক্ষা শুধু আইন নয়, জেলেদের জীবিকার নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। মা ইলিশ রক্ষায় ইকোফিস মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছে। সে অনুযায়ী তারা সরকারকে এ বিষয়ে অবহিত করেছে। সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেয়া হলেই মা ইলিশ রক্ষা সম্ভব।

নিউজটি ‍শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

আরো খবর