স্তূপ করে রাখা ইলিশ থেকে ছোট-বড় মাছ বাছাই করতে ব্যস্ত শ্রমিক। গতকাল দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম নগরের ফিশারিঘাট নতুন মাছ বাজারে
স্তূপ করে রাখা ইলিশে ভরে গেছে ঘাট। চারদিকে মাছের গন্ধ, বরফের ঠান্ডা ধোঁয়া, ক্রেতার হাঁকডাক। কেউ দর কষছেন, কেউ আবার টাটকা ইলিশ দেখে ব্যাগভর্তি করে নিচ্ছেন। গতকাল শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের কর্ণফুলী নদীর তীরে ফিশারিঘাটের নতুন মাছবাজারে গিয়ে দেখা গেল এই ব্যস্ত চিত্র।
নিষেধাজ্ঞার পর বাজার যেন নিজের ছন্দে ফিরেছে। গত ২৫ অক্টোবর সাগরে মাছ ধরার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। এর পর থেকেই একের পর এক ট্রলার ভিড়ছে ঘাটে—কোনো ট্রলারভর্তি লইট্টা, কোনোটা ছুরি, চিংড়ি, ফাইস্যা বা ইলিশে ভরপুর। ভোর থেকেই আড়তগুলোয় শুরু হয় নিলাম, পরে সেই মাছ চলে যায় শহরের বাজারে। এমনকি জেলার গ্রামীণ হাটবাজারেও পৌঁছে যাচ্ছে ট্রাকভর্তি মাছ।
গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, নদীর ঘাট ঘেঁষে ট্রলার। ঘাটে নামছে বরফঠান্ডা মাছের বাক্স। আড়তের সামনে ইলিশের স্তূপ ঘিরে ক্রেতাদের ভিড়। বিক্রেতারা তখন বরফ ছুড়ে দিচ্ছেন মাছের ওপর। ছোট আকারের ইলিশের দাম ক্রেতাদের কেউ হাঁকছেন ১০ হাজার, কেউ ১২ হাজার টাকা—শেষমেশ দর থামছে ১৬ হাজার টাকায়। ওই দরে বিক্রি হলো ১ মণ ছোট আকারের ইলিশ। এক কেজিতে পড়ছে পাঁচ থেকে ছয়টি করে মাছ।
নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরা বন্ধ থাকায় বাজারে সরবরাহে ঘাটতি ছিল। এখন ধীরে ধীরে সব ঠিক হচ্ছে। তবে গত কয়েক দিন সাগরের নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় অনেক জেলে গভীর সমুদ্রে যেতে পারেননি। ফলে বড় ইলিশ আসছে কম।
নুর মোহাম্মদ, আড়তদার
মেসার্স হাজি আবদুল গণি ফিশিংয়ের স্বত্বাধিকারী নুর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে জানান, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর থেকেই জেলেরা সমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু বড় আকারের ইলিশ এখনো তেমন ধরা পড়ছে না। ছোট ও মাঝারি ইলিশই বাজারে বেশি আসছে।
ব্যস্ত ঘাট, ব্যস্ত আড়ত
ফিশারিঘাটে এখন সকাল থেকেই যেন উৎসবের আমেজ। ট্রলার ঘাটে ভিড়লেই শুরু হয় কর্মচাঞ্চল্য। আড়তগুলোর সামনেই চলছে বাক্সে মাছ ভরানোর কাজ। আড়তদারেরা জানান, চট্টগ্রামের এই ঘাটে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়। নিষেধাজ্ঞার সময় বাজার একটু স্তিমিত থাকে। অন্য সময় লেগে থাকে ব্যস্ততা।
ছোট ইলিশ কেজিতে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার কোনো ইলিশ সাড়ে ৩০০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। বড় আকারের যেগুলো, সেগুলোর দাম একটু চড়া; প্রতি কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।
আড়তদার নুর মোহাম্মদের মতে, নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরা বন্ধ থাকায় বাজারে সরবরাহে ঘাটতি ছিল। এখন ধীরে ধীরে সব ঠিক হচ্ছে। তবে গত কয়েক দিন সাগরের নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় অনেক জেলে গভীর সমুদ্রে যেতে পারেননি। ফলে বড় ইলিশ আসছে কম। একই আক্ষেপ করলেন মেসার্স মা মরিয়ম ফিশিংয়ের কর্ণধার ছৈয়দ নুর। তিনি বলেন, বড় আকারের ইলিশ কম আসছে। তবে অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ প্রচুর ধরা পড়ছে। বিক্রিও ভালো।
দরদাম যেমন
ফিশারিঘাটের পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ছোট ইলিশ কেজিতে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার কোনো ইলিশ সাড়ে ৩০০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। বড় আকারের যেগুলো, সেগুলোর দাম একটু চড়া—প্রতি কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।

মাছের ওপর বরফ ছিটানো হচ্ছে। গতকাল দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম নগরের ফিশারিঘাট নতুন মাছ বাজারে
ইলিশ ছাড়াও অন্যান্য মাছের দাম কিছুটা কমেছে। লইট্টা প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, টাইগার চিংড়ি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, ছুরি ৩০০ টাকা, ফাইস্যা ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতিদিনই চাহিদা-সরবরাহে ওঠানামা হয়। তবে গতকাল এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা কম ছিল।
খুচরা বাজারে ইলিশের দাম এখনো বেশি। গত বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেটের কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল প্রতি কেজি ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা কেজি দরে। ওজনে একেকটি ইলিশ ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম। কেজি ২ হাজার টাকার ইলিশও রয়েছে ওই বাজারে। পাশাপাশি লইট্টা মাছের দাম পড়ছে প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা।
ইলিশের আহরণ কমছে
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতিবছর জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরকে ইলিশের ভরা মৌসুম ধরা হয়। এ বছর জুলাই ও আগস্টে দেশে আহরিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ৫১৯ টন। গত বছর একই সময়ে আহরণ করা হয়েছিল ৪০ হাজার ২৯১ টন, যা গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার ৭৭১ দশমিক ৭৮ টন কম।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশজুড়ে ইলিশ উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২৯ হাজার টন। আগের বছর ২০২২-২৩ সালে ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই সংখ্যা আরও কমবে।
যদিও এর আগের বছরগুলোয় ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ সালে ৫ লাখ ৩২ হাজার টন, ২০১৯-২০ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ সালে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন ও ২০২১-২২ সালে ৫ লাখ ৬৬ হাজার টন ইলিশ আহরিত হয়েছিল।







