১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ■ ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

/

চর বিজয়ে অগোছালো সবুজায়ন ও পর্যটনে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

চর বিজয়ে অগোছালো সবুজায়ন ও পর্যটনে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

||

দৈনিক মাটির কণ্ঠ

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Print

কুয়াকাটা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা ‘চর বিজয়’ এখন পরিবেশ ও পর্যটন বিষয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। প্রায় দুই দশক আগে উদ্ভব হলেও মাত্র ৯০ হেক্টর আয়তনের এ নবীন দ্বীপটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে অতিথি পাখি, লাল কাঁকড়া ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটন ও অপরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম দ্বীপটির টেকসই ভবিষ্যৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কুয়াকাটা পৌর শাখা চর বিজয়ে প্রায় আড়াই হাজার তাল, খেজুর, নারিকেল ও বটগাছের চারা রোপণ করে।

পৌর শাখার সাবেক আমির মাঈনুল ইসলাম মান্নান এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন। সংগঠনের দাবি, চরটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আগে সবুজায়ন জরুরি।

 

তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, চর বিজয়ের মতো ভঙ্গুর উপকূলীয় ভূখণ্ডে ম্যানগ্রোভ ছাড়া অন্য গাছ টিকবে না। চরটি নিয়মিত জোয়ারে তলিয়ে যায়, মাটি লবণাক্ত ও ভাঙনপ্রবণ।

তাই সুন্দরবন বা টেংরাগিরি থেকে ভেসে আসা কেওরা, ঝাউ বা গেওয়ার ফলই প্রাকৃতিকভাবে চরে জন্ম নিচ্ছে, যদিও এক বছরের মধ্যে সেগুলোর অনেকই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মহিপুর বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করা কেওরা ও ঝাউয়ের মধ্যে টিকে থাকা অংশ প্রমাণ করে এই চরে দীর্ঘমেয়াদে কেবল ম্যানগ্রোভই টিকে থাকতে পারে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘সুফল প্রকল্প’-এর আওতায় রোপিত এক লাখ চারা গাছের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার এখনো জীবিত আছে।চর বিজয় শীতকালে হাজার হাজার অতিথি পাখির আবাসস্থল।

এছাড়া লাল কাঁকড়ার বিচরণ, অগভীর জলে সামুদ্রিক মাছের ডিম দেওয়া এবং প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই দ্বীপের। কিন্তু শীত মৌসুমে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকের ভিড়ে পাখি উড়ে যায়, কাঁকড়ার বাসস্থান নষ্ট হয়, বর্জ্য ফেলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ।স্থানীয় জেলেরা জানান, পর্যটকদের অসচেতন আচরণ যেমন কাঁকড়ার উপর দিয়ে হাঁটা, পাখি তাড়ানো কিংবা আবর্জনা ফেলা—চরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। পরিবেশকর্মী কেএম বাচ্চু বলেন, উপকূলীয় চরভূমি কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয়, বরং টেকসই পরিবেশ সুরক্ষার একটি প্রধান হাতিয়ার। তার মতে, পিকনিক বা রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে চরে বৃক্ষরোপণের বদলে প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে পরিকল্পনা।

তিনি প্রস্তাব করেন, শীতকালে পর্যটকদের জন্য চরের বাইরে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করলে পাখিরা বিরক্ত হতো না, আবার দর্শনার্থীরাও দূর থেকে উপভোগ করতে পারতেন।বন বিভাগের অভিজ্ঞতা বলছে, উপকূলীয় ভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে কেওরা, ঝাউ ও গেওয়ার মতো ম্যানগ্রোভ গাছই সবচেয়ে কার্যকর। তবে চরের মাটি ও পানি প্রবাহ ভিন্ন হওয়ায় এসব গাছও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। চরের নামকরণকারী পরিবেশকর্মী আরিফুর রহমান বলেন, চর বিজয়ের টেকসই সবুজায়নের আগে দরকার বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা। মাটি, লবণাক্ততা ও পানির প্রবাহ বিবেচনায় না এনে কোনো বৃক্ষরোপণ কার্যকর হবে না।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব কাউসার হা‌মিদ বলেন, চর বিজয়ে শুধু চারা লাগানো নয়, গাছের পরিচর্যা, পর্যায়ক্রমিক তদারকি ও ক্ষতিগ্রস্ত অংশে পুনরায় রোপণ করাও জরুরি। যতদিন না গাছগুলো পূর্ণাঙ্গ সবুজ বেষ্টনীতে রূপ নিচ্ছে, ততদিন বনবিভাগের নিয়মিত তত্ত্বাবধান প্রয়োজন। শীতকালে চর বিজয়ে পর্যটকদের জন্য পরিবেশবান্ধব নির্দেশনা জারি করা হবে।

সনাক পটুয়াখালী সভাপতি শহিদুর রহমান বলেন, সবুজায়নকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপ দিলে ব্যর্থতার ঝুঁকি বাড়ে। স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ ও গবেষকদের সমন্বয় ছাড়া টেকসই বনায়ন সম্ভব নয়।

নিউজটি ‍শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

আরো খবর