গাড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন সুদানের সেনাবাহিনীর সদস্য। পেছনে জ্বলছে তেল পরিশোধনাগার। সুদানের উত্তর বাহরি প্রদেশ।
গত ১৮ মাস ধরে সুদানে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় চলছে। বিশেষ করে দারফুর অঞ্চলের আল ফাশের শহরে মিলিশিয়া বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) প্রবেশের পর থেকে শুরু হয়েছে নির্বিচার গণহত্যা।
দীর্ঘদিন শহরটি ঘেরাও করে রাখার পর গত সপ্তাহে আরএসএফ সেখানে প্রবেশ করে। এরপরই শুরু হয় ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ। কেবল একটি হাসপাতালেই প্রায় ৫০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে রোগী ও তাদের পরিবারও ছিল। পালিয়ে আসা বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, সাধারণ মানুষকেও বাছবিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে।
উপগ্রহচিত্রেও দেখা গেছে মাটিতে জমে থাকা রক্তের দাগ, যা বিশ্বের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা আল ফাশেরের এই হত্যাযজ্ঞকে ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার প্রথম ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে তুলনা করছেন।
আল ফাশের ছিল দারফুরে সুদানের সেনাবাহিনীর শেষ ঘাঁটি। এর পতন দেশটিতে চলমান যুদ্ধের একটি বড় মোড় পরিবর্তনের ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন সুদানের সরকারি সেনাবাহিনী (এসএএফ) ও আরএসএফ বাহিনীর মধ্যে চলছে দেশ দখলের নৃশংস লড়াই।
এই দুই পক্ষ একসময় একসঙ্গে সরকার পরিচালনা করেছিল। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা বেসামরিক গোষ্ঠীর সঙ্গে অস্বস্তিকর এক জোট সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বেসামরিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তারা একে অপরের বিরোধী হয়ে ওঠে।
২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ এখন পরিণত হয়েছে দুই পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে। উভয় পক্ষের কাছেই বিপুল অস্ত্রভান্ডার, অর্থের উৎস, হাজারো সৈন্য ও বিদেশি সমর্থন রয়েছে। এই যুদ্ধে ইতোমধ্যে দেড় লাখ মানুষ নিহত এবং কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। প্রায় তিন কোটি মানুষ এখন জরুরি মানবিক সহায়তার অপেক্ষায় আছে।
আল ফাশের শহরে ঘটতে থাকা হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতা বর্ণনাতীত। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, স্থানীয় লোকজন মিলিশিয়াদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছেন। এক কমান্ডার তাদের বলেন, “কেউ বাঁচবে না।” এরপরই গুলি চালানো হয়।
আরএসএফের বর্তমান রূপ আসলে বশির আমলের কুখ্যাত ‘জানজাউইদ’ বাহিনীর আধুনিক সংস্করণ। এখন তারা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, শক্তিশালী বিদেশি মিত্রদের সমর্থনপুষ্ট এবং নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। তারা আর উটে বা ঘোড়ায় চড়ে আসে না—এখন আসে মেশিনগান বসানো চার চাকার গাড়ি ও ড্রোনসহ।
বিশ্লেষকদের মতে, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এই সংঘাতে বড় ভূমিকা রাখছে। ইউএই দীর্ঘদিন ধরে আরএসএফের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং অতীতে ইয়েমেন যুদ্ধেও আরএসএফ যোদ্ধাদের ব্যবহার করেছিল। এখন তারা আরএসএফকে অস্ত্র ও অর্থ দিচ্ছে, যার ফলে সুদানের যুদ্ধ আরও দীর্ঘ ও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
অসংখ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ইউএই দারফুরে নিজের ভূমিকা অস্বীকার করছে। এর বিনিময়ে তারা সুদানের সোনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধ এখন কেবল অভ্যন্তরীণ নয়; এটি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ফলে এক ভয়াবহ অচলাবস্থা, রক্তক্ষয় ও ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি হয়েছে, যার শেষ এখনো অদৃশ্য।
অনেকে সুদানের এই যুদ্ধকে “ভুলে যাওয়া যুদ্ধ” বলে আখ্যা দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এটি বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর নীরবতা ও রাজনৈতিক ভণ্ডামির পরিণতি, যা আজ কোটি মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে এনেছে।







