১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ■ ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

/

মানব-অন্তরের অনন্ত দুই প্রবণতা

মানব-অন্তরের অনন্ত দুই প্রবণতা

||

দৈনিক মাটির কণ্ঠ

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Print

মানুষের বয়স বাড়ে শরীরে; কিন্তু মন ও বাসনার জগৎ অনেক সময় একই গতিতে বার্ধক্যে পৌঁছায় না। বরং মানবমনের কিছু প্রবণতা এমন যে, বয়স যত বাড়ে, আকর্ষণ ততই স্থায়ী হয়। এই বাস্তবতা আজকের মনোবিজ্ঞান প্রকাশ করলে ; মহানবী (সা.) তা বহু আগে গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি মানুষের স্বভাব, দুর্বলতা ও নৈতিক উন্নতির জন্য যে শিক্ষাগুলো দিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো—দীর্ঘ জীবন ও ধন-সম্পদের প্রতি মানুষের মৌলিক আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছেন।
কারণ এই আকাঙ্ক্ষা যদি সঠিক নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে তা হতে পারে ইবাদতের পথ; আর যদি বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তবে তা মানুষকে নৈতিক পতনের দিকে ঠেলে দিতে পারে হাদিসে এসেছে-

আবূ হুরায়রাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন রাসুল (সা.) বলেছেন:

 لَا يَزَالُ قَلْبُ الْكَبِيرِ شَابًّا فِي اثْنَتَيْنِ: فِي حُبِّ الدُّنْيَا وَطُولِ الْأَمَلِ.

‘দু’টি জিনিসের ভালবাসায় বৃদ্ধের অন্তর চির যৌবনের অধিকারী—দীর্ঘ জীবনের আকাঙ্ক্ষা এবং ধন-সম্পদের প্রতি মোহ।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪২০)

হাদিসের ব্যাখ্যা

মহানবী (সা.) এই হাদিসের মাধ্যমে মানব স্বভাবের একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক সত্য তুলে ধরেছেন। বয়স বাড়ার পরেও অন্তরের দুটি আকর্ষণ কমে না, বরং অনেক সময় আরও প্রবল হয়ে ওঠে—

১. দীর্ঘ জীবনের আকাঙ্ক্ষা (طُولُ الأَمَلِ)

ইবনে হাজর  (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন যে, ‘তুলুল-আমল’ অর্থ শুধু দীর্ঘায়ুর ইচ্ছা নয়; বরং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, পৃথিবীতে স্থায়ী হয়ে থাকার প্রবল ধারণা এবং ‘আরো কিছু দিন থাকলে আমি আরও অর্জন করতে পারব’ এই মানসিকতা।

বৃদ্ধ বয়সেও মানুষ ভাবে— ‘আরও কিছু বছর বাঁচলে আমি এই কাজটা করব’, ‘আরও কিছু সময় থাকলে বাড়িটা শেষ করব’, ‘আরও কিছু অর্জন করব, আরও কিছু গড়ব…’
আসলে এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রিত হলে দোষ নয়।
বরং ইসলাম শেখায়—দীর্ঘ জীবন পেলে তা নেক কাজে ব্যবহার করা উচিত। হাদিসে এসেছে,

আবূ বকরা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

أَنَّ رَجُلاً، قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَىُّ النَّاسِ خَيْرٌ قَالَ ‏”‏ مَنْ طَالَ عُمُرُهُ وَحَسُنَ عَمَلُهُ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ فَأَىُّ النَّاسِ شَرٌّ قَالَ ‏”‏ مَنْ طَالَ عُمُرُهُ وَسَاءَ عَمَلُهُ “

‘কোনো এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) উত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন: যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল সুন্দর হয়েছে। সে আবার প্রশ্ন করল, মানুষের মধ্যে কে নিকৃষ্ট? তিনি বললেন: যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল খারাপ হয়েছে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৩০)

কাজেই সমস্যা তখনই, যখন এই আকাঙ্ক্ষা মানুষকে আখিরাত ভুলিয়ে দেয়।
যখন মানুষ ভাবে—এ পৃথিবীর কাজই সবকিছু, তখনই এই ‘তুলুল-আমল’ তাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। 

২. ধন-সম্পদের প্রেম (حُبُّ الدُّنْيَا)

মহানবী (সা.) বলেছেন, মানুষের অন্তরে সম্পদের আকর্ষণ এমনই যে বয়সের সাথে তা অনেক সময় কমে না। বরং বৃদ্ধ বয়সে উত্তরাধিকার, আয়ের নিরাপত্তা, পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা ইত্যাদি কারণে এই মোহ আরও বেড়ে যায়।

ইসলাম সম্পদকে হারাম বলেনি। বরং হালাল উপায়ে উপার্জন ও সৎকাজে ব্যয় করার প্রশংসা করেছে।
কিন্তু ধন-মোহ যদি নৈতিক সীমা ভেঙে ফেলে—যেখানে লোভ সততা হারিয়ে দেয়, যেখানে দান কমে যায়, যেখানে আখিরাত ভুলে গিয়ে মানুষ “আরও চাই, আরও চাই”—এই চক্রে পড়তে থাকে, তখনই এই বাসনা বিপদের কারণ হয়।

কোরআন সতর্ক করে বলেছে—

إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ

`নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদ ও সন্তান তোমাদের জন্য পরীক্ষা।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ২৮)

এই হাদিস আমাদের শেখায়—

  • মানব-স্বভাবের কিছু প্রবণতা বয়স বাড়লেও অপরিবর্তিত থাকে।
  • দীর্ঘ আশা ও সম্পদের মোহ নিয়ন্ত্রণে রাখাই ঈমানী পরিপক্বতার লক্ষণ।
  • এ দুটো আকাঙ্ক্ষা যদি আখিরাতের বিস্মৃতিতে ডুবিয়ে দেয়, তবে তা বিপদ।

আবার যদি মানুষ এগুলোকে নেক আমল, দান-সদকা, সমাজ-উন্নয়ন এবং সৎ জীবনের জন্য ব্যবহার করে, তবে এগুলো আশীর্বাদে রূপ নেয়।

মানুষের অন্তর চিরযৌবনের অধিকারী—এই অর্থে নয় যে সে যুবকের মত শক্তিশালী হয়ে ওঠে; বরং এ দু’টি
আকাঙ্ক্ষা তার মনকে জীবন্ত ও সক্রিয় রাখে। ইসলাম আমাদের শেখায়—এই সক্রিয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করে আখিরাতমুখী করে তুলাই প্রকৃত সফলতা।
ধন-সম্পদ ও দীর্ঘ জীবন কামনা দোষ নয়; বরং এগুলো দিয়ে মানুষ কী করে—সত্যিকারের মূল্যায়ন সেখানেই।

নিউজটি ‍শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

আরো খবর